“মানুষের জীবন অঙ্কনির্ভর। জীবনের অঙ্ক ভুল হওয়া মানেই কর্মক্ষেত্রে বিপর্যটা ঘটা। যার জীবনের অঙ্ক যতো নির্ভুল তার জীবন ততো স্বচ্ছো ও নির্মল।” হাটখোলার মোড় থেকে প্রকাশিত দৈনিকটির একটি বিজ্ঞাপনের ভাষ্য থেকে ওপরের অংশটুকু নেয়া। বিজ্ঞাপনের শিরোনাম ‘জীবনের অঙ্ক’। পাঠকরা ইতিমধ্যেই টের পেয়েছেন, এটি একজন জ্যোতিষ বাবাজির বিজ্ঞাপন। তিনি অভয় দিয়ে জানাচ্ছেন, যাদের জীবনের অঙ্ক মিলছে না- তাদের জীবনের অঙ্ক মিলিয়ে দেবেন। মহৎ প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে। যুগে যুগে এসব ধর্মাবতাররা মানুষের জীবনের অঙ্ক মিলিয়ে দেবার জন্য কতোই না কষ্ট করেছেন। পরিশ্রম করে, বুদ্ধি খাটিয়ে, নানা রকম ফন্দি-ফিকির বের করেছেন, যাতে করে বোকা, অসহায়, অদৃষ্টবাদী মানুষের জীবনের অঙ্ক মিলিয়ে দেওয়া যায়। বিনিময়ে তারা কিইবা পান- সমাজে যথেষ্ট সম্মান পান না, আমার মতো দু’পাতা বিজ্ঞান পড়া লোকেরা তাদের নিয়ে ইয়ারকি-ফাজলামো করে। শুধু তাই নয়, ইনকাম ট্যাক্সের লোকজনও মাঝে-মধ্যে জ্বালাতন করে। ভাবখানা- না জানি কতো টাকা তারা কামিয়ে নিচ্ছেন। কেউ যদি কলাটা মূলোটা দেয়- তা নেওয়া কি দোষের। পাঠক, আপনিই বিচার করুন।
যাকগে, অঙ্কবিদের কথা থাক। বরং জীবনের অংকের উৎপত্তিটা খোঁজা যাক। প্রাচীন গ্রীসের এক গণিতবিদ পিথাগোরাস। (ভদ্রলোকের নাম বহুল পরিচিত। স্কুল জীবনে তার নামে পরিচিত একটি জ্যামিতিক উপপাদ্য বিশ্লেষণে অক্ষম হয়ে মাস্টার মশাইয়ের চড়-থাপ্পড় খাওয়ার ইতিহাস সহজে ভুলে যাবার নয়)। পিথাগোরাস শুধু গণিতবিদ ছিলেন না, তিনি একজন দার্শনিকও ছিলেন। বলা হয় দার্শনিক, মানে ফিলজফার, শব্দটি তিনিই প্রথম ব্যবহার করেন। এই পিথাগোরাস মনে করতেন জগতের সবকিছুর মূলে রয়েছে সংখ্যা। পিথাগোরাস ও তার শিষ্যদের (পিথাগোরিয়ান নামে পরিচিত) চেষ্টায় এই সংখ্যা তত্ত্বের (?) বিকাশ। তারা মানুষদেরও সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করতেন। এই সংখ্যা মেলানোর ব্যাপার থেকেই আধুনিক প্রতারণা তত্ত্ব নিউমারোলজি’র উদ্ভব ও বিকাশ। নিউমারোলজিতে বলা হয়Ñ প্রাণীদের মতো সংখ্যারও চরিত্র আছে! (সর্বনাশ!) যেমন- জোড় সংখ্যার মানেই অশুভ। জোড় সংখ্যারা হলো স্ত্রী। উল্টোদিকে বেজোড় সংখ্যা পুরুষ, তারা শুভ সূচক। (বোঝা যায়, পিথাগোরিয়ানরাও নারীবিদ্বেষী ছিলেন)। এছাড়া ১ থেকে ৮-এই সংখ্যাগুলোর আলাদা স্বভাব। ১-কর্মঠ ও ইতিবাচক, ২-আলসে আর ভিতু, ৩-ভাগ্যবান, ৪-বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন, ৫-অভিযানপ্রিয়, ৬-গৃহী, ৭-সন্ন্যাসী, ৮-সংসারী ইত্যাদি। অবশ্য এসব নিয়ে আবার কিছু মতভেদও আছে।
প্রত্যেক মানুষের জন্ম তারিখ বা তার নামের বর্ণগুলোর যোগফল তার ব্যক্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেক কথা বলতে পারে বলে নিউমারোলজিতে বলা হয়, (চাপাবাজি আর কি!)। এক্ষেত্রে ৯ থেকে বড় সংখ্যার অঙ্কগুলো পাশাপাশি যোগ করে নিতে হবে। যেমন- ২৩৮ হবে ২+৩+৮ ১৩ = ১+৩ =৪।
এভাবে জন্মদিনের তারিখ প্রত্যেকের শুভ সংখ্যা। সপ্তাহের কোনদিন ছিল জন্মদিন সেই সংখ্যাও নাকি শুভ। শুভ সংখ্যার সঙ্গে নামের সংখ্যায় মিল করার জন্য অনেকে নামের বানানও পরিবর্তন করে ফেলে! এই ধরনের প্রচেষ্টার ফলে অনেক সময় আবদুল হয় আবদেল, কমলা হয় ক্যামেলিয়া কিংবা সলিমুদ্দি হয় সেলিম-দীন ইত্যাদি।
নিউমারোলজি একটি প্রমাণিত চাপা শাস্ত্র হওয়ার পরেও মানুষের অজ্ঞতা ও অলৌকিকত্বে বিশ্বাসকে পুঁজি করে একদল ‘অঙ্কবিদ’ তাদের সম্পদ গড়ে তুলছে। জ্ঞানবিজ্ঞানের ভালো রকমের প্রসার না হলে এসব জোচ্চারদের হাত থেকে সমাজের নি®কৃতি নেই। মুশকিল হচ্ছে, এ সবের বিরুদ্ধে লড়ার মতো লোকবলের বড়োই অভাব।
একটি বহুজাতিক কোম্পানি তাদের কোমল পানীয় পানের সঙ্গে গাড়ি, টাকা, ফুটবল পুরস্কার দিচ্ছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরগুলো থেকে দেখা যায়, গাড়ি পাবার আশায় কোমল পানীয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ াত্যাধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের বিখ্যাত পীর/জ্যোতিষদের কেই কি আমাকে বলতে পারবেন, কোন পাথর ব্যবহার করলে আমি অবশিষ্ট দু’খানা গাড়ির একটির মালিক হতে পারবো?
0 লিখুন পোস্ট সম্পর্কে:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন