Browse » Home » Archives for মার্চ 2012
সোমবার, ২৬ মার্চ, ২০১২
শুক্রবার, ৯ মার্চ, ২০১২
জীবনের অঙ্ক ও কোকাকোলার গাড়ি
“মানুষের জীবন অঙ্কনির্ভর। জীবনের অঙ্ক ভুল হওয়া মানেই কর্মক্ষেত্রে বিপর্যটা ঘটা। যার জীবনের অঙ্ক যতো নির্ভুল তার জীবন ততো স্বচ্ছো ও নির্মল।” হাটখোলার মোড় থেকে প্রকাশিত দৈনিকটির একটি বিজ্ঞাপনের ভাষ্য থেকে ওপরের অংশটুকু নেয়া। বিজ্ঞাপনের শিরোনাম ‘জীবনের অঙ্ক’। পাঠকরা ইতিমধ্যেই টের পেয়েছেন, এটি একজন জ্যোতিষ বাবাজির বিজ্ঞাপন। তিনি অভয় দিয়ে জানাচ্ছেন, যাদের জীবনের অঙ্ক মিলছে না- তাদের জীবনের অঙ্ক মিলিয়ে দেবেন। মহৎ প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে। যুগে যুগে এসব ধর্মাবতাররা মানুষের জীবনের অঙ্ক মিলিয়ে দেবার জন্য কতোই না কষ্ট করেছেন। পরিশ্রম করে, বুদ্ধি খাটিয়ে, নানা রকম ফন্দি-ফিকির বের করেছেন, যাতে করে বোকা, অসহায়, অদৃষ্টবাদী মানুষের জীবনের অঙ্ক মিলিয়ে দেওয়া যায়। বিনিময়ে তারা কিইবা পান- সমাজে যথেষ্ট সম্মান পান না, আমার মতো দু’পাতা বিজ্ঞান পড়া লোকেরা তাদের নিয়ে ইয়ারকি-ফাজলামো করে। শুধু তাই নয়, ইনকাম ট্যাক্সের লোকজনও মাঝে-মধ্যে জ্বালাতন করে। ভাবখানা- না জানি কতো টাকা তারা কামিয়ে নিচ্ছেন। কেউ যদি কলাটা মূলোটা দেয়- তা নেওয়া কি দোষের। পাঠক, আপনিই বিচার করুন।
যাকগে, অঙ্কবিদের কথা থাক। বরং জীবনের অংকের উৎপত্তিটা খোঁজা যাক। প্রাচীন গ্রীসের এক গণিতবিদ পিথাগোরাস। (ভদ্রলোকের নাম বহুল পরিচিত। স্কুল জীবনে তার নামে পরিচিত একটি জ্যামিতিক উপপাদ্য বিশ্লেষণে অক্ষম হয়ে মাস্টার মশাইয়ের চড়-থাপ্পড় খাওয়ার ইতিহাস সহজে ভুলে যাবার নয়)। পিথাগোরাস শুধু গণিতবিদ ছিলেন না, তিনি একজন দার্শনিকও ছিলেন। বলা হয় দার্শনিক, মানে ফিলজফার, শব্দটি তিনিই প্রথম ব্যবহার করেন। এই পিথাগোরাস মনে করতেন জগতের সবকিছুর মূলে রয়েছে সংখ্যা। পিথাগোরাস ও তার শিষ্যদের (পিথাগোরিয়ান নামে পরিচিত) চেষ্টায় এই সংখ্যা তত্ত্বের (?) বিকাশ। তারা মানুষদেরও সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করতেন। এই সংখ্যা মেলানোর ব্যাপার থেকেই আধুনিক প্রতারণা তত্ত্ব নিউমারোলজি’র উদ্ভব ও বিকাশ। নিউমারোলজিতে বলা হয়Ñ প্রাণীদের মতো সংখ্যারও চরিত্র আছে! (সর্বনাশ!) যেমন- জোড় সংখ্যার মানেই অশুভ। জোড় সংখ্যারা হলো স্ত্রী। উল্টোদিকে বেজোড় সংখ্যা পুরুষ, তারা শুভ সূচক। (বোঝা যায়, পিথাগোরিয়ানরাও নারীবিদ্বেষী ছিলেন)। এছাড়া ১ থেকে ৮-এই সংখ্যাগুলোর আলাদা স্বভাব। ১-কর্মঠ ও ইতিবাচক, ২-আলসে আর ভিতু, ৩-ভাগ্যবান, ৪-বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন, ৫-অভিযানপ্রিয়, ৬-গৃহী, ৭-সন্ন্যাসী, ৮-সংসারী ইত্যাদি। অবশ্য এসব নিয়ে আবার কিছু মতভেদও আছে।
প্রত্যেক মানুষের জন্ম তারিখ বা তার নামের বর্ণগুলোর যোগফল তার ব্যক্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেক কথা বলতে পারে বলে নিউমারোলজিতে বলা হয়, (চাপাবাজি আর কি!)। এক্ষেত্রে ৯ থেকে বড় সংখ্যার অঙ্কগুলো পাশাপাশি যোগ করে নিতে হবে। যেমন- ২৩৮ হবে ২+৩+৮ ১৩ = ১+৩ =৪।
এভাবে জন্মদিনের তারিখ প্রত্যেকের শুভ সংখ্যা। সপ্তাহের কোনদিন ছিল জন্মদিন সেই সংখ্যাও নাকি শুভ। শুভ সংখ্যার সঙ্গে নামের সংখ্যায় মিল করার জন্য অনেকে নামের বানানও পরিবর্তন করে ফেলে! এই ধরনের প্রচেষ্টার ফলে অনেক সময় আবদুল হয় আবদেল, কমলা হয় ক্যামেলিয়া কিংবা সলিমুদ্দি হয় সেলিম-দীন ইত্যাদি।
নিউমারোলজি একটি প্রমাণিত চাপা শাস্ত্র হওয়ার পরেও মানুষের অজ্ঞতা ও অলৌকিকত্বে বিশ্বাসকে পুঁজি করে একদল ‘অঙ্কবিদ’ তাদের সম্পদ গড়ে তুলছে। জ্ঞানবিজ্ঞানের ভালো রকমের প্রসার না হলে এসব জোচ্চারদের হাত থেকে সমাজের নি®কৃতি নেই। মুশকিল হচ্ছে, এ সবের বিরুদ্ধে লড়ার মতো লোকবলের বড়োই অভাব।
একটি বহুজাতিক কোম্পানি তাদের কোমল পানীয় পানের সঙ্গে গাড়ি, টাকা, ফুটবল পুরস্কার দিচ্ছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরগুলো থেকে দেখা যায়, গাড়ি পাবার আশায় কোমল পানীয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ াত্যাধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের বিখ্যাত পীর/জ্যোতিষদের কেই কি আমাকে বলতে পারবেন, কোন পাথর ব্যবহার করলে আমি অবশিষ্ট দু’খানা গাড়ির একটির মালিক হতে পারবো?
প্রতারণার কোয়ান্টাম মেথড
কয়েক মাস আগে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি মিলনায়তনের একটি অনুষ্ঠানের খবর আমরা জানতে পারি পরদিন প্রকাশিত দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের পরিবেশিত সংবাদ থেকে। এর শিরোনাম ছিল ‘আচ্ছন্ন তন্দ্রায় নাকডাকা প্রশান্তি’। খবরের অংশ বিশেষ- ‘ভার্সিটির ছাত্র, শিক্ষক সরকারী অফিসার ও উৎসুক তরুনেরা মহাজাতকের প্রশান্তিকরণ ক্যাসেটের সুরময় অনুনাদে দুই দুইবার আচ্ছন্ন তন্দ্রায় নাকও ডাকিতে শুরু করেন। ... জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর নুরুল ইসলাম এটিকে কেবল উৎকণ্ঠা নয়, ৪০ ভাগ শারীরিক জরামুক্তির সংগ্রাম হিসেবেও মূল্য দিয়াছেন। উক্ত সভার প্রধান বক্তা শহীদ আল বোখারী (মহাজাতক) যেসব জ্ঞানগর্ভ উপদেশ খয়রাত করেন তার মূল কথা হলো- একমাত্র আহাম্মকের ভবিষ্যৎ ভাগ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।’ ঐ দিনের ঐ দৈনিকেরই প্রথম পাতায় একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। বিজ্ঞাপনটির অংশবিশেষ- ‘নিজেই নিজের ভাগ্য নিয়ন্তা হোন। মাত্র ২৮ ঘণ্টায় ব্যর্থতা থেকে সাফল্যের পথে যাত্রা শুরু করুন। মন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এখন বিশ্বে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজের ভাগ্যকে পরিবর্তন করছে। বরেণ্য ভবিষৎদ্রষ্টা ও যোগ-গুরু মহাজাতক এখন শেখাচ্ছেন মন নিয়ন্ত্রণের সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কোয়ান্টাম মেথড...।’
বিজ্ঞাপনের ভাষ্য অনুযায়ী এর মাধ্যমে ছোট বড় নারী-পুরুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা অর্জন থেকে শুরু করে অর্থ-বিত্ত, ব্যবসা, পদোন্নতি, খ্যাতি ইত্যাদি সবই পাওয়া যাবে। কোর্সটি হবে ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে। বিজ্ঞাপনে অবশ্য কোর্স ফি উল্লেখ করা হয়নি। তাহলে জানা যেত, আহাম্মকদের ঘাড়ে মহাজাতক কত টাকার কাঁঠাল ভেঙ্গে খাচ্ছেন। মন নিয়ন্ত্রণের ‘বৈজ্ঞানিক’ পদ্ধতি বলে আসলে কিছু নেই। তদুপরি- সেটা ‘কোয়ান্টাম’ হবার কোনো কারণও নেই। পদার্থবিজ্ঞানের যে শাখাটি কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা বা কোয়ান্টাম মেকানিক্স নামে পরিচিত, তার সঙ্গে এই কোর্সের কোন সম্পর্ক নেই। আছে প্রতারণার সম্পর্ক। কোয়ান্টাম বিজ্ঞান সম্পর্কে জনসাধারণের অজ্ঞতা এবং উক্ত শব্দটির আলাদা একটি ব্যঞ্জনা ব্যবহার করে প্রতারণা করার পুরোনো কৌশল।
চটকদার বুলি আউড়ে মানুষকে প্রতারণা করার এই কৌশল নতুন নয়। মানুষের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে যেসব প্রতারক তাদের প্রাসাদ তৈরি করছে, এগুলো তাদের নিত্যদিনকার ব্যাপার। আমাদের মতো দেশে, যেখানে অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের বেড়া অনেক বড়; ভক্তি ও শক্তির যেখানে রাজকীয় যোগাযোগ, সেখানে হরহামেশা এসব ঘটনা ঘটবে এ আর নতুন কি! প্রতারকদের এসব অনুষ্ঠানে সমাজের জ্ঞানী গুণীরাও থাকবেন, এ তো আমরা হর-হামেশা দেখছিও।
মানুষকে ঠকানোর জন্য আজতক যেসব পদ্ধতি মানুষ উদ্ভাবন করেছে, সম্ভবত জ্যোতিষশাস্ত্র তার শীর্ষ স্থানটি দখলে রাখতে পারে। সেই অনেককাল আগে থেকে জ্যোতিষচর্চার নামে, ভাগ্য গণনার নামে মানুষকে প্রতারিত করে আসছে একদল সুযোগসন্ধানী মানুষ। হাল আমলে এই ধরনের ব্যবসায় নতুন মাত্রা যোগ করার জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার। বিশ শতকের শেষ দশকে বিজ্ঞানের বিজয় রথ পূর্ণ বেগে ছুটে চলেছে। এ সময় তাই যে কোনো বিষয়ে বিজ্ঞানের কোন ব্যাপার জুড়ে দিতে পারলে তা হয় আরো জোরালো।
মানুষের চাঁদে যাওয়ার বিষয়টি যে সত্য নয়, বরং তা করো কারো ধর্মীয় বিশ্বাসের বারোটা বাজানোর জন্য বিধর্মীদের ষড়যন্ত্র-এমন ধারা ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী লোকের সংখ্যাও কম নয় এদেশে। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্ঘটনাকে কোন বিশেষ ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে নিজেদের ফায়দা হাসিলের চেষ্টায় রত অনেক লোক। এচক্রটি বেশ শক্তিশালী। চানখারপুলের এলেম দ্বারা তদবির করে যে লোক, উট জবেহ করে জন্ম উৎসব পালনকারী কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মন্ত্রী যে কিনা আধ্যাত্মিক পাউডারের বিজ্ঞাপনে মডেল হয়, তারা সকলেই এক সূত্রে গ্রথিত। এদের সবারই উদ্দেশ্য এক, জনগণকে সত্যের স্বরূপ জানা থেকে বিরত রাখা।
বিজ্ঞানের চলতি উন্নয়নের সঙ্গে নিজেদের প্রতারণা ব্যবসাকে আত্মীকরণের জন্য বিভিন্ন অপকৌশল ব্যবহৃত হয়ে আসছে অনেক দিন ধরে। আলোচ্য কোয়ান্টাম মেথড-এর একটি উদাহরণ মাত্র। নিয়মিত যারা হাটখোলার মোড়ের বিজ্ঞাপন নির্ভর দৈনিকটি পড়েন, তারা নিশ্চয়ই এই জাতীয় আরো প্রচারণা লক্ষ্য করে থাকবেন। এ মুহূর্তে আমার আর একটি বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ছে, যার ভাষ্য ছিল অনেকটা এরূপ ‘বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনষ্টাইন বলেছেন, পদার্থ ও শক্তি এক। কাজেই, আপনার শরীর আসলে শক্তিই, অর্থাৎ কিনা আলো। বিভিন্ন ধরনের পাথরের রয়েছে আলোকে প্রতিফলিত, প্রতিসরিত করার ক্ষমতা। কাজেই পাথর আলোর মাধ্যমে আপনার শরীরকে প্রভাবিত করে কারণ আপনি নিজে আলোচ। অতএব সঠিক পাথর ব্যবহার করে নিজের ভাগ্য গড়ে তুলুন।’ বাক্য বিন্যাস হুবহু এমত না হলেও বক্তব্য ছিলো এমনই। সাধারণভাবে, বিজ্ঞান না জানা এবং অল্প বিজ্ঞান জানা ব্যক্তিদের জন্য এটি বেশ কনভিনসিং। বিজ্ঞাপনটির বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্যণীয়। ব্যবহৃত হয়েছে এমন একজন বিজ্ঞানীর নাম, যার পরিচিতি খুব ব্যাপক। এখানে বিজ্ঞানের একটি তথ্য (শক্তি ও পদার্থ আসলে এক) পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু এ থেকে যে সিদ্ধান্ত টানা হচ্ছে (আপনার শরীর আলো দ্বারা গঠিত) তা মোটেই সত্য নয়। এভাবে সত্য থেকে মিথ্যায় উপনীত হবার যে টেকনিক উক্ত প্রতারক উদ্ভাবন করেছে তার কোন তুলনা হয় না। শক্তি ও পদার্থের অভিন্নতার তথ্যটিকে কাজে লাগিয়ে প্রতারক তার কাঙ্খিত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছেন।
হয়তো কিছু দিনের মধ্যে কম্পিউটারে ভাগ্য গণনাও শুরু হয়ে যাবে এদেশে। ‘ফরচুন টেলার’ নামে এই ধরনের সফটওয়্যার এখন রয়েছেও। এতে প্রথমে কোন ব্যক্তির জন্ম তারিখ (সঠিক দিন-ক্ষণ) ইনপুট হিসেবে দেয়া হয়, এর পর সফটওয়্যার উক্ত ব্যক্তির ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে তথ্য দিতে থাকে- এর মধ্যে থাকে ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক অবস্থা, অর্থকরী, সঠিক পেশা ইত্যাদি। সঠিক দিনক্ষণ দিতে না পারলেও আপত্তি নেই। ব্যক্তির কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বাড়তি ইনপুট হিসাবে দেয়া হয়। এরপর বের হয়ে আসে ভবিষ্যতের পঞ্জিকা।
এই ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করে অজ্ঞ ও মূখ্য লোককে প্রতারিত করাটা সহজ। এমনকি চমকে দেয়া যায় অনেক শিক্ষিত লোককেও অথচ একটু ভাবলেই বোঝা যায়, কম্পিউটার প্রোগ্রাম কোনো ব্যক্তির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু বলতে পারে না। এ ধরনের সফটওয়্যার সম্পর্কে প্রিয় পাঠকদের যদি কোনো সংশয় থাকে, তাহলে ইনপুট হিসেবে কোন মৃত ব্যক্তির জন্মক্ষণ দিয়ে দেখতে পারেন। ‘ফরচুন টেলার’ উক্ত ব্যক্তির চমৎকার ‘ভবিষ্যৎ’ বর্ণনা করতে থাকবে।
বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান উন্নতি ও জ্ঞানকে নিজেদের সংকীর্ণ পরিমন্ডলে ব্যবহার করার আর একটি প্রবণতার উল্লেখ সম্ভবতঃ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। দ্বিতীয় এ দলটি, প্রথম ও সাধারণ প্রতারক দলের চেয়ে ভিন্নতর, উদ্দেশ্যে ও কাজের ধারায়। সাধারণ প্রতারকদের মূল লক্ষ্য হল, নিজেদের আর্থিক ও বৈষয়িক উন্নতি। আর এই দলটির পরোক্ষ উদ্দেশ্য অর্থ ও ক্ষমতা লোভ হলেও বাহ্যতঃ এরা নিজেদেরকে অন্যভাবে উপস্থাপন করে। তাদের ভাব হল, মানব জাতিকে উন্নতির পথ দেখানোর কাজে তারা নিয়োজিত।
এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কতিপয় জ্ঞানপাপী। নিজের আওতা বহির্ভূত ক্ষেত্রে জ্ঞান ফলানোতে আগ্রহী এসব জ্ঞানপাপীরা প্রবলভাবে দেশকে অন্ধকার ও মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিতে চায়। সাধারণভাবে, জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিজ্ঞান চেতনার ব্যাপক প্রসারই কেবল এসব প্রগতি বিরোধিতার উপযুক্ত জবাব হতে পারে। কিন্তু কে তা করবে?
ইএসপি ও টেলিপ্যাথিবিজ্ঞানের নামে প্রতারণা
এক বন্ধুকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে বসেছি। খাওয়া-ধাওয়া আর গল্প-সল্প সবই হচ্ছিল। হঠাৎ বিষম লাগলো আমার। রীতিমতো বেকায়দায় পড়ে গেলাম। হাঁচির দমকে টেবিল ফেলে দেবার দশা আর পাশে বসে দিব্যি হাসছে আমার প্রিয় বন্ধুটি। কৌতুহলে তাকাতেই- “তোমার কথা মনে করছে, কেউ” হাসতে হাসতে বললো। আমার এই বন্ধুটি যা বলেছে, ঠিক সেই কথাগুলো আমরা হরহামেশা শুনি; যখনই খেতে বসে কারো বিষম লাগে, তখনই। কনক্লুসন হলো- কেউ যদি কাউকে স্মরণ করে এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি যদি তখন খাবার টেবিলে থাকে তখনই বিষম লাগতে পারে। লাগবেই, এটা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ এই ঘটনা নির্ভর করছে স্মরণকারী ও যাকে স্মরণ করা হচ্ছে এই ব্যক্তির সম্পর্কের মধ্যে। এই ছোট্ট ঘটনার তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো- এর মাধ্যমে আমরা বিশ্বাস করতে চাচ্ছি একজনের ‘ভাবনা’ আর একজনের কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করতে পারে। অর্থাৎ কোনো ক্ষেত্রে ‘ভাবনা’ বা চিন্তার সাহায্যে অপর কোনো ব্যক্তিকে প্রভাবিত করা যায়। অথবা নিজের ভাবনা তার মধ্যে সঞ্চারিত করা সম্ভব।
যেমন এই গল্পটির কথা ভাবুন- কোনো ধনীর দুলালীর সন্তান হলো, যা ঐ মেয়ের অভিভাবকদের অনাকাংক্ষিত। বাবা-মা প্ল্যান করে মেয়েকে বোঝালো সে একটি মৃত সন্তান প্রসব করেছে। আসলে, সুস্থ সন্তানটিকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়া হলো। কিছুদিন পর দেখা গেলো ঐ ধনীর দুলালী সব সময় কানের কাছে ‘মা’ ডাক শুনতে পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, দেখা গেল দিনের পর দিন ঐ ডাক স্পষ্ট ও জোরালো হয়ে উঠছে। স্বভাবতই এরপর গল্পে একজন সৌম্য, দাড়িওয়ালা মনোবিজ্ঞানীর আবির্ভাব ঘটে। মনোবিজ্ঞানীর আবির্ভাব ঘটে। মনোবিজ্ঞানী আবার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব এবং লজিক ছাড়া এন্টিলজিকের ধারে-কাছেও যান না। মনোবিজ্ঞানী ঘোষণা করলেন-ঐ মেয়ের হারিয়ে যাওয়া সন্তান দূরে কোথাও থেকে টেলিপ্যাথি’র মাধ্যমে তার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে এবং সফল হচ্ছে। বলার ভঙ্গিমার কারণে এই ধরনের গল্প প্রায়শ: বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে এবং পাঠকদের বিশাল অংশই ‘টেলিপ্যাথি’ নামক কারো কারো একটি বিশেষ ক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যান।
বেশ, টেলিপ্যাথি কি? সংক্ষেপে, এ হলো কোনো রকম মাধ্যম ছাড়া দূরবর্তী কোনো স্থান থেকে চিন্তার ট্রান্সমিশন। আর ‘টেলিপ্যাথির মূল অর্থ হলো- চাপাবাজি ও প্রতারণা। টেলিপ্যাথিকে গুরুত্ব দেন মনোবিদদের একটি বিশেষ দল। এনারা নিজেদের বলেন, পরামনোবিদ (প্যারা সাইকোলজিষ্ট)। আসলে হলেন বিশুদ্ধ চাপাবাজ (অথবা বোকা)। এই পরামনোবিদ্যা (প্যারা সাইকোলজিষ্ট) অনুসারে টেলিপ্যাথি হলো এক প্রকার অতীন্দ্রিয় অনুভূতি, একস্ট্রা সেনসরি পারসেপশন বা সংক্ষেপে ইএপসি (ঊঝচ)। অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার মানে হলো প্রকৃতির সঙ্গে বোঝাপড়া করার মানুষের যে পাঁচ ইন্দ্রিয় আছে, তার বাইরের কোনো ব্যাপার- স্পাই থ্রিলারের স্পাইদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। ব্রিটিশ জেমস বন্ড কিংবা আমাদের মাসুদ রানা, এদের সবারই ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়’ খুব শার্প। নতুবা ঠ্যালা সামলানো খুবই কঠিন হবে যে!
ইএসপি বোঝানোর খুব সহজ ব্যাপার আছে। ধরুন, আপনি কোনো পরিসংখ্যান অফিসে চাকুরী করেন। আপনার কাজ হলো মানুষের বাসায় টেলিফোন করে ঐ বাসায় একটি বিশেষ সাবান ব্যবহৃত হয় কি না তা খোঁজ নেয়া। আপনি টেলিফোন ডাইরেক্টরী থেকে দশটি নম্বর বাছাই করলেন এবং আশ্চর্য হয়ে জানলেন ঐ দশটি বাসাতেই আপনার কাংক্ষিত সাবানটি ব্যবহার হচ্ছে। আপনি খুব অবাক হতে পারেন, আবার নাও হতে পারেন কিন্তু আমরা ইতিমধ্যেই বুঝতে পারবো আপনার ‘ইএসপি অসাধারণ’। পরামনোবিদদের ভাষায় চিন্তা হলো তরঙ্গ। যখনই কেউ চিন্তা করে তখন সে আসলে ‘তরঙ্গ’ তৈরি করে। মানুষ ঐ তরঙ্গের গ্রাহকযন্ত্র (রিসিভার) হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। কাজেই, ফ্রিকুয়েন্সি মিললে একজনের ভাবনা আর একজনের কাছে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য যে, এই ধরনের চিন্তা তরঙ্গের কোনো অস্তিত্ব আজ পর্যন্ত আবি®কৃত হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। আর মানুষের মাথা যে রিসিভার নয়, তার বড় প্রমাণ আপনি নিজে। কারণ, প্রতি মুহূর্তে আপনার চারপাশে বিস্তর তথ্য এদিক-সেদিক হচ্ছে, মাইক্রোওয়েভে বা বেতার তরঙ্গে। এ সবের কিছুই আপনার এন্টেনা ধরতে পারছে না।
ইএসপি ও টেলিপ্যাথিকে পুঁজি করে এই জগতে প্রচুর প্রতারকের আবির্ভাব ঘটেছে, ঘটছে এবং ঘটবেও যদি না সমাজ থেকে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে ঝেটিয়ে দূর করা যায়। টেলিপ্যাথি সম্রাট নামে বিখ্যাত এই ধরনের একজন ধুরন্ধর প্রতারকের নাম ইউরি গেলার। দীর্ঘ সময় ধরে, প্রচুর বোকা মানুষকে মোহিত করে ভদ্রলোকে অনেক টাকা কামিয়েছেন। জারিজুরি ফাঁস হবার পর ভদ্রলোকের ইদানিং ব্যবসা মন্দা। তবে, তাকে নিয়ে গালগল্প ফাঁদবারতো লোকের অভাব নেই এদেশে। বিশেষ করে হাটখোলার সাপ্তাহিক ও সেগুনবাগিচার মাসিক পত্রিকাতো পাল্লা দিয়ে লিখেই চলছে।
আপনার আশপাশে যে সব টেলিপ্যাথিক ক্ষমতার অধিকারী পীর, ফকির ও সাধুবাজীরা আছেন তাদেরকে দুটো পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। প্রথমতঃ পকেট থেকে একটি টাকার নোট বের করে সেদিকে তাকিয়ে থাকুন। খেয়াল রাখবেন টেলিপ্যাথিক বাবা যেন সেটি দেখতে না পায়। এবার বাবাজীকে নোটের নম্বর জিজ্ঞেস করুন। অথবা বাবাজির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বাবাজীকে একটি কষে গালি দিন। তারপরে জিজ্ঞেস করুন আপনার ভাবনা বাবাজী ধরতে পেরেছে কি না।
পুনশ্চঃ যে বিষম খাওয়া নিয়ে এই লেখার শুরু সেই বিষম খাওয়ার মূল ব্যাপারটি, পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। খাদ্য বা পানি উদরে যাবার সময় অন্ননালীর পরিবর্তে যদি শ্বাসনালীতে ঢুকে পড়ে তাহলে শ্বাস রোধকারী একটা অবস্থা সৃষ্টি হয় এবং প্রতিবর্তী ক্রিয়া হিসেবে হিক্কা, হাঁচির মাধ্যমে দুরবস্থার নিরসন হয়।
বাণমারা কিংবা তাবিজকরা, প্রতারকের রমরমা
কয়েক মাস আগে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি মিলনায়তনের একটি অনুষ্ঠানের খবর আমরা জানতে পারি পরদিন প্রকাশিত দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের পরিবেশিত সংবাদ থেকে। এর শিরোনাম ছিল ‘আচ্ছন্ন তন্দ্রায় নাকডাকা প্রশান্তি’। খবরের অংশ বিশেষ- ‘ভার্সিটির ছাত্র, শিক্ষক সরকারী অফিসার ও উৎসুক তরুনেরা মহাজাতকের প্রশান্তিকরণ ক্যাসেটের সুরময় অনুনাদে দুই দুইবার আচ্ছন্ন তন্দ্রায় নাকও ডাকিতে শুরু করেন। ... জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর নুরুল ইসলাম এটিকে কেবল উৎকণ্ঠা নয়, ৪০ ভাগ শারীরিক জরামুক্তির সংগ্রাম হিসেবেও মূল্য দিয়াছেন। উক্ত সভার প্রধান বক্তা শহীদ আল বোখারী (মহাজাতক) যেসব জ্ঞানগর্ভ উপদেশ খয়রাত করেন তার মূল কথা হলো- একমাত্র আহাম্মকের ভবিষ্যৎ ভাগ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।’ ঐ দিনের ঐ দৈনিকেরই প্রথম পাতায় একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। বিজ্ঞাপনটির অংশবিশেষ- ‘নিজেই নিজের ভাগ্য নিয়ন্তা হোন। মাত্র ২৮ ঘণ্টায় ব্যর্থতা থেকে সাফল্যের পথে যাত্রা শুরু করুন। মন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এখন বিশ্বে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজের ভাগ্যকে পরিবর্তন করছে। বরেণ্য ভবিষৎদ্রষ্টা ও যোগ-গুরু মহাজাতক এখন শেখাচ্ছেন মন নিয়ন্ত্রণের সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কোয়ান্টাম মেথড...।’
বিজ্ঞাপনের ভাষ্য অনুযায়ী এর মাধ্যমে ছোট বড় নারী-পুরুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা অর্জন থেকে শুরু করে অর্থ-বিত্ত, ব্যবসা, পদোন্নতি, খ্যাতি ইত্যাদি সবই পাওয়া যাবে। কোর্সটি হবে ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে। বিজ্ঞাপনে অবশ্য কোর্স ফি উল্লেখ করা হয়নি। তাহলে জানা যেত, আহাম্মকদের ঘাড়ে মহাজাতক কত টাকার কাঁঠাল ভেঙ্গে খাচ্ছেন। মন নিয়ন্ত্রণের ‘বৈজ্ঞানিক’ পদ্ধতি বলে আসলে কিছু নেই। তদুপরি- সেটা ‘কোয়ান্টাম’ হবার কোনো কারণও নেই। পদার্থবিজ্ঞানের যে শাখাটি কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা বা কোয়ান্টাম মেকানিক্স নামে পরিচিত, তার সঙ্গে এই কোর্সের কোন সম্পর্ক নেই। আছে প্রতারণার সম্পর্ক। কোয়ান্টাম বিজ্ঞান সম্পর্কে জনসাধারণের অজ্ঞতা এবং উক্ত শব্দটির আলাদা একটি ব্যঞ্জনা ব্যবহার করে প্রতারণা করার পুরোনো কৌশল।
চটকদার বুলি আউড়ে মানুষকে প্রতারণা করার এই কৌশল নতুন নয়। মানুষের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে যেসব প্রতারক তাদের প্রাসাদ তৈরি করছে, এগুলো তাদের নিত্যদিনকার ব্যাপার। আমাদের মতো দেশে, যেখানে অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের বেড়া অনেক বড়; ভক্তি ও শক্তির যেখানে রাজকীয় যোগাযোগ, সেখানে হরহামেশা এসব ঘটনা ঘটবে এ আর নতুন কি! প্রতারকদের এসব অনুষ্ঠানে সমাজের জ্ঞানী গুণীরাও থাকবেন, এ তো আমরা হর-হামেশা দেখছিও।
মানুষকে ঠকানোর জন্য আজতক যেসব পদ্ধতি মানুষ উদ্ভাবন করেছে, সম্ভবত জ্যোতিষশাস্ত্র তার শীর্ষ স্থানটি দখলে রাখতে পারে। সেই অনেককাল আগে থেকে জ্যোতিষচর্চার নামে, ভাগ্য গণনার নামে মানুষকে প্রতারিত করে আসছে একদল সুযোগসন্ধানী মানুষ। হাল আমলে এই ধরনের ব্যবসায় নতুন মাত্রা যোগ করার জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার। বিশ শতকের শেষ দশকে বিজ্ঞানের বিজয় রথ পূর্ণ বেগে ছুটে চলেছে। এ সময় তাই যে কোনো বিষয়ে বিজ্ঞানের কোন ব্যাপার জুড়ে দিতে পারলে তা হয় আরো জোরালো।
মানুষের চাঁদে যাওয়ার বিষয়টি যে সত্য নয়, বরং তা করো কারো ধর্মীয় বিশ্বাসের বারোটা বাজানোর জন্য বিধর্মীদের ষড়যন্ত্র-এমন ধারা ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী লোকের সংখ্যাও কম নয় এদেশে। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্ঘটনাকে কোন বিশেষ ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে নিজেদের ফায়দা হাসিলের চেষ্টায় রত অনেক লোক। এচক্রটি বেশ শক্তিশালী। চানখারপুলের এলেম দ্বারা তদবির করে যে লোক, উট জবেহ করে জন্ম উৎসব পালনকারী কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মন্ত্রী যে কিনা আধ্যাত্মিক পাউডারের বিজ্ঞাপনে মডেল হয়, তারা সকলেই এক সূত্রে গ্রথিত। এদের সবারই উদ্দেশ্য এক, জনগণকে সত্যের স্বরূপ জানা থেকে বিরত রাখা।
বিজ্ঞানের চলতি উন্নয়নের সঙ্গে নিজেদের প্রতারণা ব্যবসাকে আত্মীকরণের জন্য বিভিন্ন অপকৌশল ব্যবহৃত হয়ে আসছে অনেক দিন ধরে। আলোচ্য কোয়ান্টাম মেথড-এর একটি উদাহরণ মাত্র। নিয়মিত যারা হাটখোলার মোড়ের বিজ্ঞাপন নির্ভর দৈনিকটি পড়েন, তারা নিশ্চয়ই এই জাতীয় আরো প্রচারণা লক্ষ্য করে থাকবেন। এ মুহূর্তে আমার আর একটি বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ছে, যার ভাষ্য ছিল অনেকটা এরূপ ‘বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনষ্টাইন বলেছেন, পদার্থ ও শক্তি এক। কাজেই, আপনার শরীর আসলে শক্তিই, অর্থাৎ কিনা আলো। বিভিন্ন ধরনের পাথরের রয়েছে আলোকে প্রতিফলিত, প্রতিসরিত করার ক্ষমতা। কাজেই পাথর আলোর মাধ্যমে আপনার শরীরকে প্রভাবিত করে কারণ আপনি নিজে আলোচ। অতএব সঠিক পাথর ব্যবহার করে নিজের ভাগ্য গড়ে তুলুন।’ বাক্য বিন্যাস হুবহু এমত না হলেও বক্তব্য ছিলো এমনই। সাধারণভাবে, বিজ্ঞান না জানা এবং অল্প বিজ্ঞান জানা ব্যক্তিদের জন্য এটি বেশ কনভিনসিং। বিজ্ঞাপনটির বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্যণীয়। ব্যবহৃত হয়েছে এমন একজন বিজ্ঞানীর নাম, যার পরিচিতি খুব ব্যাপক। এখানে বিজ্ঞানের একটি তথ্য (শক্তি ও পদার্থ আসলে এক) পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু এ থেকে যে সিদ্ধান্ত টানা হচ্ছে (আপনার শরীর আলো দ্বারা গঠিত) তা মোটেই সত্য নয়। এভাবে সত্য থেকে মিথ্যায় উপনীত হবার যে টেকনিক উক্ত প্রতারক উদ্ভাবন করেছে তার কোন তুলনা হয় না। শক্তি ও পদার্থের অভিন্নতার তথ্যটিকে কাজে লাগিয়ে প্রতারক তার কাঙ্খিত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছেন।
হয়তো কিছু দিনের মধ্যে কম্পিউটারে ভাগ্য গণনাও শুরু হয়ে যাবে এদেশে। ‘ফরচুন টেলার’ নামে এই ধরনের সফটওয়্যার এখন রয়েছেও। এতে প্রথমে কোন ব্যক্তির জন্ম তারিখ (সঠিক দিন-ক্ষণ) ইনপুট হিসেবে দেয়া হয়, এর পর সফটওয়্যার উক্ত ব্যক্তির ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে তথ্য দিতে থাকে- এর মধ্যে থাকে ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক অবস্থা, অর্থকরী, সঠিক পেশা ইত্যাদি। সঠিক দিনক্ষণ দিতে না পারলেও আপত্তি নেই। ব্যক্তির কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বাড়তি ইনপুট হিসাবে দেয়া হয়। এরপর বের হয়ে আসে ভবিষ্যতের পঞ্জিকা।
এই ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করে অজ্ঞ ও মূখ্য লোককে প্রতারিত করাটা সহজ। এমনকি চমকে দেয়া যায় অনেক শিক্ষিত লোককেও অথচ একটু ভাবলেই বোঝা যায়, কম্পিউটার প্রোগ্রাম কোনো ব্যক্তির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু বলতে পারে না। এ ধরনের সফটওয়্যার সম্পর্কে প্রিয় পাঠকদের যদি কোনো সংশয় থাকে, তাহলে ইনপুট হিসেবে কোন মৃত ব্যক্তির জন্মক্ষণ দিয়ে দেখতে পারেন। ‘ফরচুন টেলার’ উক্ত ব্যক্তির চমৎকার ‘ভবিষ্যৎ’ বর্ণনা করতে থাকবে।
বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান উন্নতি ও জ্ঞানকে নিজেদের সংকীর্ণ পরিমন্ডলে ব্যবহার করার আর একটি প্রবণতার উল্লেখ সম্ভবতঃ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। দ্বিতীয় এ দলটি, প্রথম ও সাধারণ প্রতারক দলের চেয়ে ভিন্নতর, উদ্দেশ্যে ও কাজের ধারায়। সাধারণ প্রতারকদের মূল লক্ষ্য হল, নিজেদের আর্থিক ও বৈষয়িক উন্নতি। আর এই দলটির পরোক্ষ উদ্দেশ্য অর্থ ও ক্ষমতা লোভ হলেও বাহ্যতঃ এরা নিজেদেরকে অন্যভাবে উপস্থাপন করে। তাদের ভাব হল, মানব জাতিকে উন্নতির পথ দেখানোর কাজে তারা নিয়োজিত।
এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কতিপয় জ্ঞানপাপী। নিজের আওতা বহির্ভূত ক্ষেত্রে জ্ঞান ফলানোতে আগ্রহী এসব জ্ঞানপাপীরা প্রবলভাবে দেশকে অন্ধকার ও মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিতে চায়। সাধারণভাবে, জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিজ্ঞান চেতনার ব্যাপক প্রসারই কেবল এসব প্রগতি বিরোধিতার উপযুক্ত জবাব হতে পারে। কিন্তু কে তা করবে?
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)